আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
মোঃ এনামুল হক
সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের
2011-1432
﴿ دور الزكاة في تنمية المجتمع ﴾
« باللغة البنغالية »
محمد إنعام الحق
مراجعة: محمد عبد القادر
2011 - 1432
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা
মোঃ এনামুল হক
ভূমিকা
ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য তেমনি যাকাতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুখী সমৃদ্ধিশালী প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আল্লাহর বাণী—
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰة﴾ [البقرة:43]
তোমরা সালাত কায়েম কর যাকাত দাও। উনিশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সূচনা হলেও মূলত বিশ শতকে পশ্চাত্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ কল্যাণ নীতির উদ্ভব ঘটে। একবিংশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়নকেই বুঝায়। অধ্যাপক বেনহাম (Benham) এ কথাই বলেন। তার মতে ‘‘ যে রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাই কল্যাণ রাষ্ট্র।’’ আর সামাজিক নিরপত্তা বলতে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নূন্যতম অর্থনৈতিক প্রয়োজন পুরণের নিশ্চয়তাকেই বুঝায়। জি.ডি. এইস. কোল (G.D.H. Cole) এর মতে, ‘‘কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নাগরিকের একটি সাধারণ জীবন যাত্রার মানের নিশ্চয়তা থাকে।’’
পুঁজিবাদী সমাজে সরকারীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান নেই বলেই সেখানে জনগণকে মুষ্টিমেয় ধনকুবের বা পুঁজিপতিদের কৃপার দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকতে হয়। এখানে ডলার পুজায় নিবেদিত সাইলক পুঁজিপতিরা লৌকিকতার খাতিরে কিছু দান করেন, মহানুভবতা বা সংবেদনশীলতার জন্য নয়; মেথ্য আরনল্ড শোষণ ও বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদি সমাজ চিত্রকে তুলে ধরেন এভাবে ‘‘আমাদের অসাম্য উচ্চশ্রেণীকে বৈষয়িক করে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ইতর, আর নিম্ন শ্রেণীকে বর্বর করে তোলে।’’ পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ-নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রমিক, জনতা সমাজতন্ত্রের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু এখানেও অবস্থা তথৈবচ। সমাজতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বের যাতাকলে শ্রমিক জনগণ নিপীড়িত। There is a little room for even a genuine philanthropic deed when all human beings are turned into robots employed and paid by the vast sprowling fumbling leviathan of the soviets. ‘‘সেখানে সত্যিকার জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সুযোগ নেই বললেই চলে। যেখানে সকল মানুষ রোবট কর্মচারীতে পরিণত হয় এবং শক্তিশালী সোভিয়েত এর এক বিরাট সংখ্যক আনাড়ীদের দ্বারা বেতন প্রদত্ত হয়।’’ সমাজতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হতে পারে এমন- সমাজতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সামাজিক অন্যায় অবিচারের এক অতি নিকৃষ্ট রূপ। যার দৃষ্টান্ত কোন নমরুদ, ফিরাউন ও চেংগিস খানের শাসনকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক বা একাধিক ব্যক্তি বসে একটি সামাজিক দর্শন রচনা করলো। তারপর সরকারের সীমাহীন এখতিয়ারের বদৌলতে এ দর্শনকে অন্যায়ভাবে একটি দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিল। মানুষের ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়া হলো। জমি-জমা, ক্ষেত-খামার অযাচিতভাবে হস্তগত করা হলো। কল-কারখানা রাষ্ট্রয়াত্ত করা হলো। সমগ্র দেশকে এমন এক জেলখানায় পরিণত করা হলো যে সমালোচনা, বিচার প্রার্থনা, অভিযোগ, মামলা দায়ের ইত্যাদি কাজ করা এবং বিচার বিভাগীয় সুবিচারের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেল। দেশে কোন দল থাকবে না, কোন সংগঠন থাকবে না, যেখানে থেকে মানুষ তাদের মুখ খুলতে পারে; কোন প্রেস-মিডিয়া থাকবে না যার সাহায্যে মানুষ তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারে; কোন বিচারালয় থাকবে না, যার দুয়ারে সুবিচারের জন্য মানুষ ধর্ণা দিতে পারে।
এখানে প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রটি এই যে, তা ব্যক্তিকে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে পরিবার, গোত্র, সমাজ ও জাতির ওপর জুলম নিষ্পেষণ করার পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিল এবং সামষ্টিক কল্যাণের জন্য সমাজের কাজ করার শক্তি শিথিল করে দিয়েছিল। অপরদিকে দ্বিতীয় ব্যবস্থা তথা সমজতন্ত্রে ত্রুটি এই ছিল যে, রাষ্ট্রকে সীমাহীন ক্ষমতা দান করে ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র ও সমাজের স্বাধীনতা প্রায় একেবারেই খতম করে দিয়েছে। তারপর ব্যক্তিবর্গ থেকে সমষ্টির কাজ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে এতো বেশি কর্তৃত্ব দান করে যে, ব্যক্তি ব্যক্তিসত্তার পরিবর্তে একটি মেশিনের প্রাণহীন যন্ত্রাংশের রূপ ধারণ করে।
পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যখন ব্যর্থ, তখন পুঁজিবাদের সংস্কারিতরূপ ‘‘কল্যাণরাষ্ট্রে’’ সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত আংশিক ছাড়া সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের ইংরেজ প্রবক্তা উইলিয়াম বেভারিজ প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার সমালোচনায় তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেন, ‘‘আমি মিথ্যা আশ্বাস এবং অবান্তর কল্পনাশ্রয়ী দর্শনের মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারণা করতে চাই না।’’
এ কথা ধ্রূব সত্য যে, পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্র একই আয়নার দুটো পিঠ। ওদিকে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং কল্যাণ রাষ্ট্র উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে একই বিন্দু থেকে উৎসারিত। এই তিনটি মতবাদ কেবল বৈষয়িক বা বস্তগত তথা প্রযুক্তিনির্ভর উন্নতি সমৃদ্ধি চায়, আত্মিক, নৈতিক ও মানবিক উৎকর্ষ সেখানে উপেক্ষিত। অথচ আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধের উপস্থিতি ছাড়া বস্ত্তগত উন্নতি ফলপ্রসু ও কার্যকর হয় না।
আলড়ুয়াস হ্যক্সলি তাইতো বলেন- ‘এটি এমন এক স্পষ্ট পশ্চাদগামী পৃথিবী যেখানে কেবল প্রযুক্তির সদর্প বিচরণ চলে। প্রযুক্তিগত প্রগতি ধ্রূব, কিন্তু বদান্যতার প্রসারণ ছাড়া প্রযুক্তিগত প্রগতি মূল্যহীন। বরং মূল্যহীনতার চেয়েও ক্ষতিকর।’
মানুষ একাধারে আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, জৈবিক ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে সমন্বিত জীব। মানব এককে আত্মা, মন, নৈতিক চেতনা, যৌন তাড়না, বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, পরার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, বিন